কিভাবে মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টন হয় ২০২৪

কিভাবে মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টন হয়-cybersheba.com
সম্পদের ন্যায্য বন্টন নিশ্চিত করতে ফারায়েজের নিয়মগুলি প্রতিটি মুসলিম পরিবারের জানা উচিত।

মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টন করা হয় দুটি শ্রেণীতে – অংশীদার ও অবশিষ্টভোগী। অংশীদারে রয়েছে ১২ জন ওয়ারিশ, আর অবশিষ্টভোগীতে অনেকেই হয়ে থাকে যেটা এই পোষ্টে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টন একটি সুনির্দিষ্ট ও সুসংহত প্রক্রিয়া। ইসলামে মৃত ব্যক্তির সম্পদ তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টনের বিস্তারিত বিধান রয়েছে যা ফারায়েজ নামে পরিচিত। মুসলিম ফারায়েজ আইন নির্ধারণ করে কিভাবে একজন মুসলমানের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি বণ্টিত হবে।

এই পোষ্টে ফারায়েজ বন্টনের ক্যালকুলেটর নিয়েও আলোচনা করা হবে, যাতে সহজে মুসলিম ফারায়েজ অনুযায়ী আমরা সম্পত্তির বন্টন করতে পারি।

মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টন কি?

মুসলিম ফারায়েজ আইন অনুসারে, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি তার স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বন্টন করতে হবে। এখানে প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্পত্তি বন্টনের পূর্বশর্ত

মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বন্টনের আগে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পূরণ করতে হয়। যেমন, দাফন-কাফনের খরচ মেটানো, ঋণ পরিশোধ, স্ত্রীদের দেনমোহর পরিশোধ এবং যদি মৃত ব্যক্তি কোনো অসিয়ত করে থাকে তা সম্পন্ন করা। এই সব কাজ সম্পন্ন করার পরই বাকি সম্পত্তি বন্টনের প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।

মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার কারা

মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে মূলত দুইটি প্রধান শ্রেণি রয়েছেঃ শেয়ারার (অংশীদার) এবং রেসিডুয়ারি (অবশিষ্টভোগী বা আসাবা)। এ নিয়ম অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ভাগ করা হয়। নিচে এই দুটি শ্রেণি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

শেয়ারার বা অংশীদার

শেয়ারার বা অংশীদার বলতে বোঝানো হয় সেই ওয়ারিশদের, যারা ইসলামী আইনে নির্ধারিত অংশের অধিকারী। এই শ্রেণিতে মোট ১২ জন ওয়ারিশ রয়েছেন,  তন্মধ্যে ৪ জন পুরুষ এবং ৮ জন মহিলা যাদের নির্দিষ্টভাবে সম্পত্তিতে অংশ দেওয়া হয়। এরা হলঃ

  1. বাবা
  2. স্বামী
  3. দাদা
  4. বৈপিত্রেয় ভাই
  5. স্ত্রী
  6. মা
  7. দাদী
  8. বোন
  9. কন্যা
  10. ছেলের কন্যা
  11. বৈমাত্রেয় বোন
  12. বৈপিত্রেয় বোন

এ শ্রেণির ওয়ারিশরা ইসলামী আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির অধিকারী। তাদের অংশ নির্ধারিত থাকে এবং এ অংশ বন্টনের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন করা যায় না।

রেসিডুয়ারি বা আসাবা (অবশিষ্টভোগী)

রেসিডুয়ারি বা আসাবা হচ্ছে সেই ওয়ারিশ, যারা শেয়ারারদের অংশ বন্টনের পর অবশিষ্ট সম্পত্তি ভোগ করেন। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো অংশ নেই, তবে প্রথম শ্রেণির অংশীদারদের অংশ প্রদানের পর অবশিষ্ট সম্পত্তিতে তারা ভাগ করে নেন। এই শ্রেণির মধ্যে কয়েকটি স্তর রয়েছেঃ

  1. সন্তানঃ মৃত ব্যক্তির ছেলে এবং কন্যা প্রথম শ্রেণির অবশিষ্টভোগী হিসেবে বিবেচিত। ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের চেয়ে বেশি অংশ পান।
  2. পূর্ববর্তী বংশধরঃ বাবার মতো পূর্ববর্তী বংশধররাও অবশিষ্টভোগী হিসেবে বিবেচিত হন, যেমন দাদা।
  3. ভাই ও বোনঃ বাবার বংশধরেরা, যেমন ভাই, বোন, বৈমাত্রেয় বোন, বৈপিত্রেয় ভাই, ভাইয়ের ছেলে এবং তাদের ছেলেরা অবশিষ্ট সম্পত্তির অধিকারী
    হতে পারেন।
  4. চাচা ও তাদের বংশধরঃ দাদার বংশধররাও এই শ্রেণিতে পড়ে, যেমন চাচা, বৈমাত্রেয় চাচা, চাচার ছেলে এবং তাদের পরবর্তী বংশধররা।

উল্লেখ্য, স্থানভেদে একই ব্যক্তি কখনো শেয়ারার হিসেবে অংশ পেতে পারে, আবার কখনো রেসিডুয়ারি হিসেবেও সম্পত্তির অধিকারী হতে পারে। ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের এই বৈশিষ্ট্যটি সম্পত্তি বণ্টনের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত।

স্বামী ও স্ত্রীর অধিকার

স্বামী এবং স্ত্রী পরস্পরের সম্পত্তির ওপর নির্দিষ্ট ভাগ পান। স্বামী তার স্ত্রীর সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ (১/৪) পাবেন যদি সন্তান থাকে, আর সন্তান না থাকলে অর্ধেক (১/২) পাবেন। স্ত্রী পাবে এক-অষ্টমাংশ (১/৮) যদি সন্তান থাকে, আর সন্তান না থাকলে এক-চতুর্থাংশ (১/৪) পাবে।

সন্তানদের অধিকার

ছেলে-মেয়েরা মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। ছেলেরা মেয়েদের দ্বিগুণ অংশ পায়। একাধিক মেয়ে থাকলে তারা দুই-তৃতীয়াংশ (২/৩) অংশ ভাগ করে নেয়। একজন মেয়ে হলে সে অর্ধেক (১/২) সম্পত্তি পায়।

পিতা-মাতার অধিকার

মাতাপিতা সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। পিতা যদি সন্তান থাকে তবে এক-ষষ্ঠাংশ (১/৬) এবং যদি সন্তান না থাকে তবে সম্পূর্ণ সম্পত্তি পান। মা সন্তানের ক্ষেত্রে এক-ষষ্ঠাংশ (১/৬) অথবা এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) অংশ পান।

অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের অধিকার

মৃত ব্যক্তির ভাইবোন, পিতামহী, মাতামহী, চাচা, খালা ইত্যাদি অন্যান্য আত্মীয়রা কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সম্পত্তির অংশ পেতে পারেন। তবে, এটি নির্ভর করে কতজন প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী আছে তার ওপর।

বন্টনের পদ্ধতি

বন্টনের প্রক্রিয়া শুরু করার আগে মৃত ব্যক্তির যাবতীয় দায়-দেনা পরিশোধ করতে হবে। এরপর তার সম্পদ তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ফারায়েজ অনুযায়ী ভাগ করতে হবে। প্রথমে স্বামী-স্ত্রী, তারপর সন্তান, পরে পিতা-মাতা এবং তারপর অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যে এই সম্পদ বন্টন করা হয়।

উত্তরাধিকার হিসাব করার ক্যালকুলেটর

সাধারণত অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া উত্তরাধিকারদের সম্পত্তির পরিমাণ হিসাব করতে পারেনা। কিন্তু সরকারি ভাবে একটা অফিসিয়াল ক্যালকুলেটর আছে যেটার মাধ্যমে মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টনের হিসাব করা যায়। ক্যালকুলেটরটি দেখার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন।

Inheritance-Calculator-কিভাবে মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টন হয়-cybersheba.com
যেসব আইনের উপর ভিত্তি করে মুসলিম আইনে সম্পত্তির বন্টন করা হয়ঃ

  • শরীয়া আইন, ১৯৩৭
  • মুসলিম বিবাহ আইন, ১৯৩৭
  • মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ (অধ্যাদেশ নং ৮)
  • মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক আইন, ১৯৭৪

সাধারণ ভুল ধারণা

অনেকেই মনে করেন যে পিতার সম্পত্তি থেকে সন্তানকে ত্যাজ্য করা যেতে পারে, যা সম্পূর্ণ ভুল। ইসলামে ত্যাজ্য করার মাধ্যমে সন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় না। এছাড়া সৎ সন্তান সৎ বাবা-মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না।

শেষ কথা

মুসলিম আইনে সম্পত্তি বন্টন একটি পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি সঠিকভাবে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করা হয়। সম্পদের ন্যায্য বন্টন নিশ্চিত করতে ফারায়েজের নিয়মগুলি প্রতিটি মুসলিম পরিবারের জানা উচিত।

Picture of Ali Hayder

Ali Hayder

আমি আলী হায়দার, সাইবার সেবা'র একজন নিমিত ব্লগার। অনলাইন আর্নিং, আইটি প্রফেশন, কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং ইত্যাদি বিষয়ের উপর আমার ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। এই ওয়েবসাইটে ই-সার্ভিস নিয়ে নিয়মিত লেখা-লেখি করছি।

ফেসবুকঃ https://www.facebook.com/alihayder2050/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *