বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব দেয় এরকম দেশ খুব কমই আছে। আজকের বৈশ্বিক দুনিয়ায় অনেকেই বিদেশে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চান। তবে বেশিরভাগ দেশেই নাগরিকত্ব পাওয়ার নিয়ম-কানুন কঠোর এবং দীর্ঘমেয়াদি।
কিন্তু কিছু কিছু দেশ আছে যেখানে বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায়, এবং এই প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। এই লেখায় আমরা বিস্তারিত জানবো বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায় এমন কিছু দেশের সম্পর্কে।
Table of Contents
কেন বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়
বিয়ে একটি বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সম্পর্ক। বিভিন্ন দেশের সরকার এই সম্পর্কের ভিত্তিতে বিদেশিদের নাগরিকত্ব প্রদান করে থাকে, যাতে পারিবারিক একত্রীকরণ সম্ভব হয় এবং একজন নাগরিক তার সঙ্গীকে স্বাভাবিক জীবন-যাপনের সুযোগ করে দিতে পারেন। ফলে বিয়ে হয়ে ওঠে একটি কার্যকর মাধ্যম বৈধভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য।
স্পেনঃ এক বছরের ব্যবধানে নাগরিকত্ব
দক্ষিণ ইউরোপের বৃহৎ দেশ স্পেনে বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া বেশ সহজ। স্প্যানিশ কোনো নাগরিককে বিয়ে করলে মাত্র এক বছর একসঙ্গে বসবাস করলেই আপনি নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন। স্পেনের আইন অনুযায়ী, বৈধ বিয়ের সনদ এবং একসঙ্গে বসবাসের প্রমাণ হলেই আবেদন করা যায়। এছাড়া প্রাথমিক স্প্যানিশ ভাষাজ্ঞান ও দেশটির সংস্কৃতি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকা উত্তম। একবার স্পেনের নাগরিকত্ব পেলে আপনি লাতিন আমেরিকা, ফিলিপাইন ও পর্তুগালের মতো দেশেও দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা পাবেন।
আর্জেন্টিনাঃ দুই বছর পর নাগরিকত্ব
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনাতেও বিয়ের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। আর্জেন্টিনার নাগরিককে বিয়ে করলে দুই বছর পরে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ জন্য প্রয়োজন হবে বৈধ বিয়ের প্রমাণ, স্প্যানিশ ভাষার সাধারণ জ্ঞান এবং অপরাধমুক্ত থাকার প্রমাণ। দেশটি বিদেশিদের প্রতি তুলনামূলক সহনশীল এবং উন্মুক্ত হওয়ায় এই নিয়ম কার্যকরভাবে কাজ করে।
মেক্সিকোঃ সহজ প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব
মেক্সিকোতে বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব। মেক্সিকান নাগরিককে বিয়ে করে তার সঙ্গে দুই বছর একসঙ্গে বসবাস করলেই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। এর জন্য স্প্যানিশ ভাষার মৌলিক দক্ষতা, বৈধ বিয়ের সনদ ও সহবাসের প্রমাণ দরকার। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মেক্সিকোর নাগরিকত্ব পেলেও আপনার আগের দেশের নাগরিকত্ব রাখতে পারবেন, যা অনেক দেশের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না।
তুরস্কঃ তিন বছরের বৈধ বৈবাহিক সম্পর্কই যথেষ্ট
তুরস্কে বৈধভাবে বিয়ে করে তিন বছর একসঙ্গে দাম্পত্য জীবন কাটালেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। তুরস্কের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য দেশটির ভাষা বা সংস্কৃতির জ্ঞান বাধ্যতামূলক নয়। তুর্কি পাসপোর্টের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—এটি দিয়ে ১১০টিরও বেশি দেশে ভিসা ছাড়াই বা অন অ্যারাইভাল ভিসায় ভ্রমণ করা যায়।
সুইজারল্যান্ডঃ কঠোর নিয়মে নরম পথ
সুইজারল্যান্ড সাধারণত অভিবাসন নীতিতে কঠোর হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আছে। একজন সুইস নাগরিককে বিয়ে করে তিন বছর একসঙ্গে থাকলে এবং পাঁচ বছর দেশটিতে বসবাস করলে নাগরিকত্বের আবেদন করা যায়। যারা দেশের বাইরে থাকেন, তারা ছয় বছর বিবাহিত থাকলে আবেদন করতে পারেন। আবেদনের জন্য প্রয়োজন হয় ভাষাজ্ঞান, সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা এবং সুইস সমাজে মিশে যাওয়ার প্রমাণ।
কেপ ভার্ডঃ বিয়েই যথেষ্ট
পশ্চিম আফ্রিকার দ্বীপদেশ কেপ ভার্ডে, যেখানে বিয়ের পরই নাগরিকত্বের আবেদন করা যায়। এই দেশে বসবাস করা বাধ্যতামূলক নয়, কেবল বৈধ বিয়েই যথেষ্ট। এটি বিশ্বের খুব কম দেশেই দেখা যায় যেখানে এত সহজে নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব।
আরও কিছু দেশ
উল্লেখিত দেশগুলো ছাড়াও আরও কিছু দেশ আছে যেখানে বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায়, বা বিয়ের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি ও পরবর্তীতে নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব। নিচে এমন কিছু অতিরিক্ত দেশের তালিকা ও সংক্ষিপ্ত তথ্য দেওয়া হলো:
১. ফ্রান্স
নাগরিকত্বের যোগ্যতাঃ ফরাসি নাগরিককে বিয়ে করার পর কমপক্ষে ৪ বছর একসঙ্গে থাকা লাগবে। যদি বিদেশে বসবাস করেন তবে সময় হতে পারে ৫ বছর।
শর্তঃ ফরাসি ভাষায় মৌলিক দক্ষতা, অপরাধমুক্ত রেকর্ড, ও বিয়ের বৈধতা।
২. যুক্তরাষ্ট্র (USA)
নাগরিকত্ব নয়, প্রথমে গ্রিন কার্ড দেওয়া হয়।
বিবাহিত থাকলে এবং একসঙ্গে কমপক্ষে ৩ বছর বসবাস করলে নাগরিকত্বের আবেদন করা যায়।
শর্তঃ গ্রীন কার্ড, বৈধ বিয়ে, একসঙ্গে বসবাসের প্রমাণ, ইংরেজি ও মার্কিন ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান।
৩. জার্মানি
জার্মান নাগরিককে বিয়ে করলে আপনি স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাবেন। ৩ বছর পর নাগরিকত্বের আবেদন করা সম্ভব।
শর্তঃ জার্মান ভাষা জানা, সামাজিকভাবে মিশে যাওয়া, অপরাধমুক্ত রেকর্ড।
৪. কানাডা
কনজুগাল পার্টনার বা স্পাউস হিসেবে আপনাকে স্পনসর করতে পারেন কানাডিয়ান নাগরিক।
সরাসরি নাগরিকত্ব নয়, তবে স্থায়ী বসবাস (PR) পাওয়া যায়। ৩ বছর পর নাগরিকত্বের আবেদন করা যায়।
৫. পর্তুগাল
পর্তুগিজ নাগরিককে বিয়ে করলে ৩ বছর বৈধ দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখলে নাগরিকত্বের আবেদন করা যায়।
শর্তঃ বিয়ের রেজিস্ট্রেশন পর্তুগালে হওয়া জরুরি নয়, কিন্তু রেকর্ড থাকতে হবে।
৬. ব্রাজিল
ব্রাজিলিয়ান নাগরিককে বিয়ে করলে বিদেশি স্বামী/স্ত্রী স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পান এবং দুই বছর পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন।
শর্তঃ বিয়ের প্রমাণ, বসবাসের ইতিহাস, ব্রাজিলিয়ান সমাজে মিশে যাওয়ার প্রমাণ।
৭. ইতালি
একজন ইতালিয়ান নাগরিককে বিয়ে করলে আপনি ২ বছর ইতালিতে বসবাসের পর নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন (বিদেশে থাকলে ৩ বছর)।
শর্তঃ ইতালিয়ান ভাষার জ্ঞান (কমপক্ষে B1 লেভেল), অপরাধমুক্ত রেকর্ড।
৮. ফিলিপাইনস
যদিও বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়া কঠিন, তবে ফিলিপিনো নারীকে বিয়ে করে আপনি ফিলিপাইনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেন (বিশেষত রিটায়ারমেন্ট ওয়ার্ক ভিসার মাধ্যমে)।
দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা
বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পাওয়ার সুবিধার পাশাপাশি অনেক দেশ দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতিও দেয়। এর মানে হলো আপনি নতুন দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার পাশাপাশি নিজের দেশের নাগরিকত্বও বজায় রাখতে পারবেন। যেমন স্পেন, মেক্সিকো ও আর্জেন্টিনা এই সুবিধা দেয়। ফলে আপনি দুটি দেশের সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন—স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, চাকরি ও ভোটাধিকারসহ আরও অনেক কিছু।
শেষকথা
বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব—এই সুযোগ অনেকের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা। তবে মনে রাখতে হবে, এটি শুধুই নাগরিকত্ব পাওয়ার একটি পথ, কোনো কৌশল নয়। প্রতিটি দেশে এই প্রক্রিয়ার আইনি ও নৈতিক দিক রয়েছে। তাই বিয়ের আগে বা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার আগে সেই দেশের আইনি নিয়ম-কানুন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি।