নারী নির্যাতন মামলার আসামি কি বিদেশে যেতে পারবে

নারী নির্যাতন মামলার কারণে অনেক বিদেশ গমনেচ্ছু বিদেশ যেতে পারেনা। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ২০০০ সালে প্রণীত হয় ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’। এই আইনে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যৌতুক, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, এসিড নিক্ষেপ, অপহরণসহ নানা ধরণের অপরাধ।

এসব অপরাধের জন্য কঠোর দণ্ডের বিধান রয়েছে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ডও নির্ধারিত। ফলে নারী নির্যাতন মামলার গুরুত্ব বিচার ব্যবস্থায় অত্যন্ত উচ্চ। তবে এ আইনটি যেহেতু অনেক ক্ষেত্রে আপসযোগ্য নয়, তাই আসামির বিদেশ যাত্রার প্রশ্নে কিছু জটিলতা তৈরি হয়। আজকের পোস্টে আমরা জানব নারী নির্যাতন মামলার আসামি বিদেশ যেতে পারবে কিনা বা পারলেও কি কি বাধা-নিষেধ আছে।

বিদেশযাত্রা অধিকার ও সংবিধান

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনভাবে দেশের ভেতরে চলাফেরা এবং বিদেশে যাতায়াত ও পাড়ি জমানোর অধিকার রয়েছে। তবে এ অধিকারে কিছু যুক্তিসংগত সীমাবদ্ধতা আরোপ করা যায়, বিশেষত যদি নিরাপত্তা বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু কেবলমাত্র কোনো মামলার আসামি হওয়া বা নাম থাকা মানেই এই অধিকার অটোমেটিকভাবে খর্ব হবে না।

মামলার কারণে বিদেশ যাত্রার নিষেধাজ্ঞা

নারী নির্যাতন মামলার আসামির বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য আদালতের নির্দিষ্ট নির্দেশ প্রয়োজন হয়। হুট করে পুলিশ বা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ কাউকে আটকে দিতে পারে না, যদি না আদালত সেই নির্দেশ দিয়ে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাসপোর্ট জব্দ করা হয়, অথবা ইমিগ্রেশনকে মৌখিকভাবে অবহিত করা হয়—যা একেবারেই আইনি নয় এবং সংবিধান পরিপন্থী।

আদালতের নির্দেশ ছাড়া পাসপোর্ট জব্দ বা ট্রাভেল ব্যান

সাম্প্রতিক একাধিক হাইকোর্ট রায়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির পাসপোর্ট জব্দ করা বা বিদেশ গমন নিষিদ্ধ করা যাবে না যদি না তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগে চার্জ গঠন হয় এবং সেই মামলায় আদালত নির্দেশ দেয়। শুধুমাত্র সন্দেহ বা এফআইআরে নাম থাকার কারণে কাউকে বিদেশে যেতে বাধা দেওয়া যাবে না। এমনকি মামলার তদন্ত চললেও, অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতের পূর্বানুমতি নিয়ে বিদেশ যেতে পারেন।

মামলার অবস্থা ও বিদেশ যাত্রার সম্ভাবনা

যদি নারী নির্যাতন মামলাটি তদন্ত পর্যায়ে থাকে এবং আসামি জামিনে থাকেন, তাহলে তিনি সাধারণত আদালতের অনুমতি নিয়ে বিদেশ যেতে পারেন। তবে অভিযোগপত্র দাখিলের পর এবং চার্জ গঠনের পরে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যায়। তখন আদালতের নির্দেশ ছাড়া বিদেশ গমন আইনি বাধার মুখে পড়ে। যদি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা ওয়ারেন্ট থাকে, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি ইমিগ্রেশন পয়েন্টে আটক হতে পারেন।

হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ ও তার প্রভাব

বর্তমানে দেশে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার বিচারাধীন নারী নির্যাতন মামলার মধ্যে প্রায় ৯৫০টি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। এই স্থগিতাদেশ থাকা অবস্থায় মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। অনেক সময় আসামিরা এই স্থগিতাদেশকে বিদেশ যাত্রার অনুমতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে আদালতের অনুমতি ছাড়া এই সময়েও বিদেশ যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। স্থগিত আদেশে যদি ‘বিদেশ গমনে বাধা নেই’ মর্মে কিছু উল্লেখ না থাকে, তাহলে ইমিগ্রেশন বাধা দিতে পারে।

নারী নির্যাতন মামলায় বিচার বিলম্ব ও বিদেশযাত্রা

নারী নির্যাতন মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব একটি বড় সমস্যা। তথ্য অনুযায়ী, প্রতি চারটি মামলার একটি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলে। এই দীর্ঘ সময় মামলা চলতে থাকায় অনেক আসামির ব্যক্তিজীবনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, বিশেষ করে বিদেশে কাজ বা উচ্চশিক্ষার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। তবুও, দেশের আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অনেক সময় বিদেশ গমনে জটিলতা রয়ে যায়।

ব্যতিক্রমী রায় ও উদাহরণ

ব্যতিক্রমী রায় ও উদাহরণ - নারী নির্যাতন মামলার আসামি কি বিদেশে যেতে পারবে - cybersheba.com

সম্প্রতি হাইকোর্ট নারী নির্যাতনের একটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা স্থগিত রেখেছেন এই শর্তে যে, তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে সংসার করছেন। এই উদাহরণ দেখায়, বিচার বিভাগ বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় রায় দিতে পারেন। আবার অনেক সময় দেখা গেছে, হাইকোর্ট ১১ গ ধারাকে আপসযোগ্য করতে বলেছেন, যাতে ট্রাইব্যুনাল আপসরফা উৎসাহিত করতে পারে। এমন উদ্ভাবনী রায় আইনি গতি বাড়াতে পারে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পেশাগত ও পারিবারিক জীবনকে সচল রাখতেও সাহায্য করে।

শেষ কথা ও সুপারিশ

নারী নির্যাতন মামলার গুরুত্ব আছে। তবে এই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিদেশ যাত্রা সংক্রান্ত প্রশ্নটি আইনি ও মানবাধিকারের ভারসাম্যের বিষয়। একদিকে যেমন ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি অন্যদিকে আসামির মৌলিক অধিকার রক্ষা করাও প্রয়োজন। আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ছাড়া বিদেশ যাত্রায় বাধা দেওয়া সংবিধান বিরোধী। ফলে:

  • আদালতের পূর্বানুমতি ছাড়া ইমিগ্রেশন নিষেধাজ্ঞা জারি করা যাবে না।
  • পাসপোর্ট জব্দ সংক্রান্ত আদেশ কেবলমাত্র আদালতের মাধ্যমেই হতে পারে।
  • হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে স্পষ্ট উল্লেখ থাকা উচিত বিদেশ যাত্রার অনুমতি আছে কিনা।
  • ট্রাইব্যুনালের মামলায় দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
  • আসামিকে বিদেশ গমনের প্রয়োজন হলে আদালতে আবেদন করে সেই অনুমতি নেওয়া জরুরি।

সবশেষে বলা যায়, নারী নির্যাতন মামলা অত্যন্ত সংবেদনশীল ও জটিল একটি আইনগত বিষয়। বিদেশ গমন প্রশ্নেও একই ধরনের গুরুত্ব, ভারসাম্য ও ন্যায়ের প্রয়োগ প্রয়োজন।

Picture of Ali Hayder

Ali Hayder

আমি আলী হায়দার, সাইবার সেবা'র একজন নিমিত ব্লগার। অনলাইন আর্নিং, আইটি প্রফেশন, কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং ইত্যাদি বিষয়ের উপর আমার ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। এই ওয়েবসাইটে ই-সার্ভিস নিয়ে নিয়মিত লেখা-লেখি করছি।

ফেসবুকঃ https://www.facebook.com/alihayder2050/