খুনের মামলার আসামি কি বিদেশ যেতে পারবে

খুনের মামলার আসামি কি বিদেশ যেতে পারবে-cybersheba.com
আপনার বিরুদ্ধে যদি খুনের মামলা চলে, তবে প্রথম কাজ হবে আইনি পরামর্শ গ্রহণ এবং আদালতের অনুমতি নিয়ে যথাযথভাবে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করা।

খুনের মামলার আসামি বিদেশ যেতে পারবে কিনা তা নির্ভর করে মামলার অবস্থা এবং জামিনের শর্তের উপর। বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ধরণের অপরাধ হলো হত্যা বা খুনের মামলা।

যদি কারো বিরুদ্ধে খুনের মামলা চলে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে—খুনের মামলার আসামি কি বিদেশ যেতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আইনি প্রেক্ষাপট, মামলার অবস্থা, জামিনের শর্ত এবং আদালতের আদেশের উপর। এই পোস্টে আমরা এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করব।

পাসপোর্ট আইন, ১৯৭৩ অনুসারে, বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনস্বার্থ কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষার্থে যেকোনো ব্যক্তির বিদেশ গমন সীমিত বা নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। যদি সরকার মনে করে যে একজন ব্যক্তি বিদেশে গিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করতে পারেন, অথবা তার বিদেশ যাত্রা রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে, তাহলে তার পাসপোর্ট জব্দ করা কিংবা তাকে ইমিগ্রেশন থেকে ফেরত পাঠানো সম্পূর্ণ বৈধ।

ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC)-এর ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি একটি ফৌজদারি মামলায় আসামি হন এবং মামলা বিচারাধীন থাকে, তাহলে তিনি আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশ ত্যাগ করতে পারেন না। এই বিধান সরাসরি প্রযোজ্য হয় যখন একজন খুনের মামলার আসামি বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ, খুনের মতো গুরুতর অভিযোগ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও বিচারিক প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত।

খুনের মামলার আসামি আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশ ছাড়লে সেটি ফৌজদারি কার্যবিধির পরিপন্থী হিসেবে গণ্য হয়। অনেক সময় দেখা যায়, আসামি জামিনে থাকলেও তার জামিননামায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে যে তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না, অথবা আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশত্যাগ করা যাবে না। এই অবস্থায়, খুনের মামলার আসামি যদি অনুমতি ছাড়া বিদেশে যান, তবে তার জামিন বাতিল হয়ে যেতে পারে এবং তার বিরুদ্ধে ফের নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হতে পারে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, খুনের মামলার আসামি যখন বিদেশে পালানোর চেষ্টা করেন, তখন আদালত সেই বিষয়টি একটি “ফ্লাইট রিস্ক” হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এতে করে আসামির প্রতি আদালতের আস্থা হ্রাস পায় এবং ভবিষ্যতে জামিন পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। অনেক সময় রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের কাছে আবেদন করে যাতে খুনের মামলার আসামির পাসপোর্ট জব্দ করা হয় কিংবা তার নামে ইমিগ্রেশন অ্যালার্ট জারি করা হয়।

একটি খুনের মামলায় তদন্তের সময়, প্রাথমিকভাবে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেই তাকে বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হতে পারে। কারণ, তদন্তাধীন অবস্থায় যদি আসামি দেশ ছেড়ে চলে যান, তাহলে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, মামলার অগ্রগতি এবং ন্যায়বিচারের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থা আদালতের মাধ্যমে সেই ব্যক্তির নামে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করে থাকে।

ইমিগ্রেশন বা বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা কখন আরোপ হয়?

ইমিগ্রেশন বা বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা কখন আরোপ হয় - খুনের মামলার আসামি কি বিদেশ যেতে পারবে-cybe

আপনার নামে মামলা থাকলে ইমিগ্রেশনে গিয়ে হয়ত জানতে পারেন যে আপনার বিরুদ্ধে “রেড অ্যালার্ট” রয়েছে। এরকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রেঃ

  • আপনার নামে খুন বা গুরুতর অপরাধের মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
  • আপনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
  • আপনি জামিনে থাকলেও আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশ ত্যাগ করছেন।
  • সরকার কোনো Exit Control Order (ECO) দিয়েছে।

এই সকল পরিস্থিতিতে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা আপনার বিদেশ যাত্রা বাধা দিতে পারেন, বিশেষ করে যখন আপনি খুনের মামলার আসামি।

খুনের মামলার আসামির আদালতের আদেশ ও জামিনের শর্ত

খুনের মামলার আসামি যদি জামিনে থাকেন, তাহলে তার বিদেশে যাওয়ার অধিকার সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আদালতের দেয়া জামিন আদেশ এবং তার শর্তাবলীর উপর। সাধারণত জামিন আদেশে আদালত স্পষ্ট করে উল্লেখ করে থাকেন যে, “Without prior permission from the court, the accused shall not leave the country”। এর মানে, খুনের মামলার আসামি আদালতের পূর্বানুমতি ছাড়া বিদেশে যেতে পারবেন না। যদি আসামি এ ধরনের শর্ত উপেক্ষা করে দেশ ত্যাগ করেন, তাহলে তা জামিনের শর্ত লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার জামিন বাতিল হয়ে যেতে পারে।

জামিনের শর্তে বিদেশ যাত্রা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকা খুব সাধারণ একটি বিষয়, বিশেষ করে যখন বিষয়টি খুনের মতো একটি গুরুতর অপরাধের সাথে সম্পর্কিত। আদালত মনে করে, খুনের মামলার আসামি যদি দেশত্যাগ করেন, তবে মামলার তদন্তে অসুবিধা হতে পারে, সাক্ষীদের জেরা করা সম্ভব নাও হতে পারে, কিংবা আসামি পলাতক হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।

তবে সব ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় না। আদালত যদি দেখেন যে আসামি দেশে ফেরার নিশ্চয়তা দিতে পারেন এবং বিদেশ যাত্রার পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে, তাহলে শর্তসাপেক্ষে বিদেশ গমনের অনুমতি দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপঃ

  • চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশ যাত্রাঃ অনেক সময় খুনের মামলার আসামির স্বাস্থ্যগত অবস্থা এমন হতে পারে যা দেশে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আসামি মেডিকেল রিপোর্টসহ একটি আবেদন করলে আদালত বিদেশ যাত্রার অনুমতি দিতে পারে নির্দিষ্ট সময়সীমা ও শর্তসাপেক্ষে।

  • উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ যাত্রাঃ কোনো আসামি যদি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে পারেন, যেমন—বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার, স্কলারশিপ বা কোর্সের সময়সীমা ইত্যাদি দেখাতে পারেন, তাহলে আদালত কিছু বিশেষ শর্তে অনুমতি দিতে পারেন।

  • আন্তর্জাতিক ক্রীড়াগ্রহণে অংশগ্রহণঃ একজন খুনের মামলার আসামি যদি কোনো জাতীয় দলের সদস্য হন এবং আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতে চান, তবে বিচারক এই বিষয়টিও বিবেচনা করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে আদালত সাধারণত বিদেশে যাত্রা ও ফিরে আসার নির্ধারিত সময়সীমা এবং দেশে ফিরে আদালতে হাজির হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন।

তবে আদালতের অনুমতি নিয়ে বিদেশ গমনের সময় যদি খুনের মামলার আসামি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশে না ফেরেন, তাহলে তা জামিন লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হতে পারে।

এখানে মনে রাখতে হবে, আদালত সবসময় রাষ্ট্র ও মামলার স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। তাই যদি আদালত মনে করেন যে খুনের মামলার আসামির বিদেশ যাত্রা মামলার প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে, তাহলে তিনি অনুমতি না-ও দিতে পারেন—even যদি বিদেশে যাওয়ার কারণ যৌক্তিক হয়।

খুনের মামলার আসামির আদালতে উপস্থিত থাকার গুরুত্ব

যেকোনো ফৌজদারি মামলায়, বিশেষ করে খুনের মতো গুরুতর মামলায়, বিচার চলাকালে আসামির আদালতে উপস্থিত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণঃ

  • অভিযোগ গঠনের দিনে অনুপস্থিত থাকলে জামিন বাতিল হয়ে যেতে পারে।
  • আপনার পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণের সময় উপস্থিত থাকা আইনি অধিকার।
  • সাফাই সাক্ষীর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন অনুপস্থিত থাকলে।

খুনের মামলার আসামি হয়ে বিদেশে গেলে আদালত আপনাকে ‘ফেরারী’ হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। এমনকি অনুপস্থিতিতেই বিচার শেষ করে রায় দিয়ে দিতে পারে।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে কী হয়?

আপনার বিরুদ্ধে যদি কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থাকে, তাহলে আপনি কোনোভাবেই দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। কারণ, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল রেকর্ড দেখে আপনাকে থামিয়ে দেবে এবং আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করবে।

এমনকি আপনি যদি আগেই বিদেশে থাকেন, তাহলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে Red Notice দিয়ে আপনাকে দেশে ফেরত আনার চেষ্টাও হতে পারে। অতএব, খুনের মামলায় পরোয়ানা থাকলে বিদেশে থাকা বা যাওয়া—দুই-ই ঝুঁকিপূর্ণ।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “প্রত্যেক অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ হিসেবে গণ্য হবেন।” তাই, খুনের মামলার আসামি হলেও তিনি কিছু মৌলিক অধিকার পানঃ

  • উকিল নেয়ার অধিকার
  • জামিন চাওয়ার অধিকার
  • সাক্ষ্য প্রদানের অধিকার
  • আদালতের অনুমতিতে বিদেশ যাওয়ার আবেদন করার অধিকার

তবে এসব অধিকার প্রয়োগ করতে হলে আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হয়।

বিদেশ যাওয়ার জন্য অনুমতি নেওয়ার পদ্ধতি

বিদেশ যাওয়ার জন্য একজন খুনের মামলার আসামি নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে আবেদন করতে পারেনঃ

  1. নিজের আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদনপত্র তৈরি করুন।
  2. আবেদন করুন সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে।
  3. আবেদনে অবশ্যই বিদেশে যাওয়ার কারণ (যেমন: চিকিৎসা, শিক্ষা, চাকরি) ও মেয়াদ উল্লেখ করুন।
  4. আদালত যদি প্রয়োজন মনে করে, তাহলে পুলিশ প্রতিবেদন চাইতে পারে।
  5. আদেশ পেলে কোর্টের অনুমতিপত্র দেখিয়ে ইমিগ্রেশনে যেতে পারবেন।

অন্যদিকে, যদি নিম্ন আদালত অনুমতি না দেয়, তবে হাইকোর্টে রিট করে স্থগিতাদেশ ও বিদেশযাত্রার অনুমতি চাওয়া যেতে পারে।

পালিয়ে গেলে কী হতে পারে?

আপনি যদি খুনের মামলার আসামি হয়ে অনুমতি ছাড়া বিদেশে চলে যান, তাহলেঃ

  • আপনার জামিন বাতিল হবে।
  • আপনার বিরুদ্ধে ফেরারী ঘোষণা আসবে।
  • পাসপোর্ট বাতিল হতে পারে।
  • পরবর্তীতে আদালতে অনুপস্থিতিতে রায় হতে পারে।
  • আপনার বিদেশি কর্মসংস্থান বা পড়াশোনা বাতিল হতে পারে।

এছাড়া আপনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে সাজার রায় কার্যকর করারও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।

শেষ কথা

খুনের মামলার আসামি হয়ে সরাসরি বা গোপনে বিদেশে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং আইনবিরুদ্ধ। আপনার বিরুদ্ধে যদি খুনের মামলা চলে, তবে প্রথম কাজ হবে আইনি পরামর্শ গ্রহণ এবং আদালতের অনুমতি নিয়ে যথাযথভাবে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে চললে আপনার আইনি অধিকার যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি ভবিষ্যতের সমস্যা থেকেও আপনি রক্ষা পাবেন।

Picture of Ali Hayder

Ali Hayder

আমি আলী হায়দার, সাইবার সেবা'র একজন নিমিত ব্লগার। অনলাইন আর্নিং, আইটি প্রফেশন, কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং ইত্যাদি বিষয়ের উপর আমার ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। এই ওয়েবসাইটে ই-সার্ভিস নিয়ে নিয়মিত লেখা-লেখি করছি।

ফেসবুকঃ https://www.facebook.com/alihayder2050/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *