একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে জীবনের একটি অন্যতম শিক্ষা পেলাম। একটি ধূসর শীতের সকালে শহরের ব্যস্ত পথে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একজন ভবঘুরের। মাথায় জট পাকানো চুল, ময়লা জামা-কাপড়, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি।
সেদিনই মনে হলো- এই মানুষটির সঙ্গে একদিন কাটাই। এই ভাবনা থেকেই শুরু হলো ‘একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন’-এর গল্প। সমাজের প্রান্তিক এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা, তাদের সংগ্রাম, এবং আমাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই লেখা। পুরোটা পড়বেন, আশাকরি অনেক কিছু উপলব্ধি করবেন।
Table of Contents
- সকালের সাক্ষাৎঃ রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে
- জীবনের গল্পঃ কেন ভবঘুরে জীবন বেছে নিলেন
- দৈনন্দিন সংগ্রামঃ একদিনের আহার জোগাড় করা
- সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিঃ ভবঘুরেদের প্রতি আমাদের মনোভাব
- অদেখা প্রতিভাঃ ভবঘুরেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দক্ষতা
- শীতের রাত্রিঃ ফুটপাতে জীবন কাটানো
- মানবতার প্রশ্নঃ আমরা কতটা সহমর্মী
- ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের শিক্ষা
সকালের সাক্ষাৎঃ রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন এক সকালে শহরের পুরনো বাজার সংলগ্ন চায়ের দোকানে বসে আছি। দোকানের ভাঙা টিনের ছাদ দিয়ে আঁকাবাঁকা রোদের রেখা পড়েছে মেঝেতে। হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে এক কর্কশ অথচ কাতর কণ্ঠ ভেসে এলো, “ভাইয়া, এক কাপ চা দিবেন…” চায়ের দোকানের মালিক ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “আবার এসেছ? গতকালের টাকা দেবে কখন?”
একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের এই প্রথম মুহূর্তে আমি দেখলাম কীভাবে সেই মানুষটি লজ্জায় মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। তার জীর্ণ পাঞ্জাবির হাতা থেকে বেরিয়ে থাকা হাড় জিরজিরে হাতটি কাঁপছিল। আমি তাকে ডেকে বললাম, “এসো ভাই, আমার সঙ্গে বসো। দু’কাপ চা দেন।”
সে প্রথমে অবাক হয়ে তাকাল, তারপর সতর্কভাবে এসে বেঞ্চের এক কোণে বসল। চায়ের কাপে তার আঙুলগুলো এমন শক্ত করে চেপে ধরল যে মনে হল সেটাই হয়তো তার দিনের প্রথম উষ্ণতা। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর এই শুরুতেই আমি লক্ষ করলাম, কীভাবে দোকানের অন্য ক্রেতারা আমাদের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, কেউ কেউ even তাদের চেয়ার একটু সরিয়ে নিচ্ছে।
ধীরে ধীরে কথায় কথায় জানা গেল, লোকটি একসময় এই এলাকারই একজন স্বাভাবিক বাসিন্দা ছিল। “পাগল ডাকাটা মোটেও ভালো লাগে না, কিন্তু এখন আর কিছু বলার নেই,” – সে বলল এক ধরনের অভ্যস্ত আত্মসমর্পণের সুরে। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের আলাপচারিতায় আমি উপলব্ধি করলাম, সমাজের দেওয়া তকমা কীভাবে একজন মানুষের স্বতন্ত্র সত্ত্বাকে গ্রাস করে নেয়।
চায়ের শেষ ফোঁটা মুখে দিতে দিতে হঠাৎ সে বলল, “আপনিই প্রথম মানুষ যিনি আমার নাম জানতে চাইলেন… যদিও আমি বলিনি।” তার চোখের কোণে জমে থাকা জল দেখে আমি বুঝতে পারলাম, এই সামান্য আচরণটুকুই হয়তো তার দীর্ঘদিনের অমানবিক আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের বিরুদ্ধে প্রথম স্বীকৃতি। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের এই সাক্ষাৎ আমাকে শিক্ষা দিয়েছিল যে, অনেক সময় একজন মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে দেখাই হতে পারে সবচেয়ে বড় উপহার।
জীবনের গল্পঃ কেন ভবঘুরে জীবন বেছে নিলেন
চায়ের উষ্ণ ধোঁয়া আমাদের মধ্যে একটা আন্তরিকতার সেতুবন্ধন তৈরি করল। তিনি আঙুল দিয়ে কাপের কিনারা বাজাতে বাজাতে বলতে শুরু করলেন, “দেখুন, একসময় আমারও ছিল তিনতলা বাড়ি, গাড়ি, দামি ঘড়ি।” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর এই মুহূর্তে আমি দেখলাম কীভাবে তার চোখের দৃষ্টি দূর অতীতে হারিয়ে গেল।
“২০০৮ সালের বাজারে ধ্বস সব শেষ করে দিল,” তার কণ্ঠে বেজে উঠল এক অদৃশ্য বেদনা। “ব্যবসার ঋণ শোধ করতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে বিদেশে পাঠালাম, নিজে থাকলাম লড়াই করতে।” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের এই কথোপকথনে উঠে এলো এক নির্মম সত্য – আমাদের সমাজে পতন মানেই সমস্ত সম্পর্কের অবসান।
তিনি হঠাৎ থামলেন, তারপর এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম যখন আদালতের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমারই ভাই আমাকে ‘পাগল’ প্রমাণ করতে আইনজীবী নিয়োগ করেছে।” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, আত্মীয়তার বন্ধন কতটা ভঙ্গুর হতে পারে অর্থ ও মর্যাদার কাছে।
বিকেলের রোদ যখন কমতে শুরু করেছে, তখন তিনি তার বর্তমান জীবন সম্পর্কে বললেন, “এখন মনে হয় এই মুক্ত জীবনই ভালো। কারো কাছে জবাবদিহি নেই, প্রত্যাশা নেই।” কিন্তু একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর অভিজ্ঞতায় আমি দেখতে পেলাম, এই ‘মুক্তি’র দাবির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর সামাজিক আঘাতের দাগ।
সন্ধ্যা নামার আগে তিনি একটি মর্মস্পর্শী স্বীকারোক্তি করলেন, “মাঝে মাঝে রাতে স্বপ্ন দেখি সেই পুরনো বাড়িটায় ফিরে গেছি। তারপর ঘুম ভেঙে দেখি এই ফুটপাত… প্রথম প্রথম কাঁদতাম, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।” একদিনের এই সত্যিকারের গল্পটি আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে সাফল্য-ব্যর্থতার সংজ্ঞা সম্পর্কে।
তার জীবনের এই টুকরো গল্পগুলো থেকে আমি বুঝলাম, ভবঘুরেদের অধিকাংশই আসলে আমাদেরই মতো সাধারণ মানুষ ছিল, যাদের জীবন একদিন হঠাৎই অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। ভাগ্যের চাকা যে কারো জীবেই ঘুরে যেতে পারে – এটা শুধু তাদের গল্প নয়, আমাদের সকলেরই সম্ভাব্য গল্প।
দৈনন্দিন সংগ্রামঃ একদিনের আহার জোগাড় করা
সকাল সাতটায় তার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই শুরু হলো এক অদৃশ্য যুদ্ধ – আজকের খাবার জোগাড়ের সংগ্রাম। আমি প্রত্যক্ষ করলাম কীভাবে প্রতিটি গ্রাস ভাতের জন্য তাকে লড়াই করতে হয়। প্রথম গন্তব্য এলাকার একটি মন্দির, যেখানে সকালের প্রসাদ বিতরণ হয়। “যদি ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারি, তাহলে হয়তো একমুঠো খিচুড়ি জুটবে,” তিনি বললেন দ্রুত পায়ে চলতে চলতে।
মন্দিরের গেটে পৌঁছাতেই দেখা গেল অন্তত ত্রিশজন ভবঘুরে একই আশায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রসাদ শেষ হয়ে গেল তার পালা আসার আগেই। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের এই দৃশ্য আমাকে শিখিয়েছিল, ভিক্ষায়ও যে প্রতিযোগিতা থাকে, তা আগে কখনো ভাবিনি। তিনি মাথা নিচু করে বললেন, “আজ আরেক জায়গায় চেষ্টা করতে হবে।”
বেলা এগারোটায় আমরা পৌঁছালাম একটি বিয়ের বাড়ির পিছনের গলিতে। “ধনী বাড়ির বিয়েতে রান্না বেশি হয়, বাকি খাবার ফেলে দেয়,” তিনি ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু আজ সেখানকার রাঁধুনি তাদের তাড়িয়ে দিল। আমি দেখলাম, কীভাবে অপমানকে তিনি গলধঃকরণ করেন – অভ্যাসের মতো। “কিছু লোক মনে করে আমরা ইচ্ছে করেই এই জীবন বেছে নিয়েছি,” তিনি বললেন একটু কষ্টের হাসি দিয়ে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে আমরা একটি ফাস্ট ফুডের দোকানের পিছনে দাঁড়ালাম। একজন কর্মী বেরিয়ে এসে একটি পলিথিনে কিছু খাবার দিলেন। “এটা গতকালের বার্গার, খাওয়ার মতোই আছে,” বললেন কর্মীটি। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি অবাক হয়েছিলাম, কীভাবে তিনি আনন্দিত হলেন এই ‘বাতিল’ খাবারে। “আজকে তো রাতের খাবারও জুটে গেল,” তিনি বললেন সন্তুষ্ট চোখে।
সন্ধ্যায় এক দয়ালু মহিলা আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন, হাতে একটি টিফিন ক্যারিয়ার। “বাবা, এই নিন গরম ভাত আর ডাল,” বললেন তিনি। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর শেষ প্রহরে এই দৃশ্য আমার চোখে জল এনে দিল। “এমন মানুষও আছে যারা আমাদের মানুষ হিসেবেই দেখে,” আমার সঙ্গী বললেন কৃতজ্ঞতাভরে।
দিন শেষে আমি উপলব্ধি করলাম, আমাদের শহরে প্রতিদিন টনকে টনকে খাবার নষ্ট হয়, অথচ একজন ভবঘুরের জন্য একবেলা গরম খাবার জোগাড় করাই এক মহাসংগ্রাম। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি বুঝেছি, ক্ষুধার বিরুদ্ধে এই প্রতিদিনের লড়াই কতটা ক্লান্তিকর এবং মানবিক মর্যাদাহানিকর হতে পারে।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিঃ ভবঘুরেদের প্রতি আমাদের মনোভাব
শহরের প্রধান সড়কে লক্ষ্য করলাম কীভাবে পথচারীরা ফুটপাথে বসে থাকা ভবঘুরেদের দিকে তাকায় না। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি দেখলাম, কীভাবে আমরা তাদেরকে ‘অদৃশ্য’ করে ফেলেছি আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে। আমার সঙ্গী মৃদু হেসে বললেন, “আমরা যেন শহরের মানচিত্রে থাকা অদৃশ্য কালি। সবাই দেখেও না দেখার ভান করে।”
বিকেলে একটি ক্যাফেতে বসে থাকার সময় এক দম্পতি আমাদের দিকে তাকিয়ে নাক সিঁটকালেন। “দেখেন কীভাবে মানুষ ভাবে আমরা অসভ্য, অশিক্ষিত?” তিনি বললেন। “কিন্তু এই একই মানুষগুলো জানেন না যে আমি একসময় ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম, ইংরেজি সাহিত্য পড়তাম।” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি বুঝলাম, আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা সংকীর্ণ – আমরা শুধু বাইরের আবরণ দেখি, ভেতরের গল্প জানতে চাই না।
সন্ধ্যায় একটি শপিং মলে প্রবেশ করতে গিয়ে গার্ড আমাদের থামিয়ে দিলেন। “ভবঘুরেদের ঢুকতে দেওয়া হয় না,” বললেন তিনি কঠিন সুরে। আমার সঙ্গী বললেন, “আমি শুধু টয়লেট ব্যবহার করতে চাইছিলাম।” গার্ড মাথা নাড়লেন। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি প্রত্যক্ষ করলাম, কীভাবে সামান্য মৌলিক সুবিধাগুলো থেকেও তারা বঞ্চিত।
রাতের খাবারের সময় তিনি একটি মর্মস্পর্শী গল্প শোনালেনঃ “গত বছর এক শিশু আমাকে বিস্কুট দিতে এসেছিল। তার মা তাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন, বললেন ‘ওদের কাছ থেকে দূরে থাক, ওরা খারাপ মানুষ’।” আমি উপলব্ধি করলাম, কীভাবে ছোটবেলা থেকেই আমরা ভবঘুরেদের সম্পর্কে ভুল ধারণা শিখে আসি।
দিন শেষে আমি বুঝতে পারলাম, সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ভবঘুরেদেরই ক্ষতি করে না, এটি আমাদের মানবিকতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি শিখেছি যে, প্রতিটি মানুষেরই একটি গল্প আছে – এবং সেই গল্প শোনার জন্য আমাদের হৃদয় খুলে দিতে হবে। সমাজ তখনই সত্যিকারের সভ্য হবে, যখন আমরা প্রত্যেককে তাদের মর্যাদা দিতে শিখব।
অদেখা প্রতিভাঃ ভবঘুরেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দক্ষতা
দুপুরের রোদ যখন মাথার উপর তেতে উঠেছে, তখনই আমার ভবঘুরে সঙ্গী তার ব্যাগের গভীর থেকে একটি পাতলা হয়ে যাওয়া বই বের করলেন। বইয়ের প্রচ্ছদটি প্রায় উঠে গেছে, কিন্তু তিনি পাতায় পাতায় এমন নিমগ্ন হয়ে পড়ছিলেন যেন এটি ব্র্যান্ড নিউ। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর এই মুহূর্তে আমি আবিষ্কার করলাম, শেক্সপিয়রের সনেটগুলো তিনি এমন স্বাচ্ছন্দ্যে পড়ছেন যেন এটি তার দৈনন্দিন অভ্যাস।
আমার কৌতূহল দেখে তিনি হাসলেন, “একসময় কলেজে প্রথম হয়েছিলাম ইংরেজিতে, এখন শুধু স্মৃতি।” কথায় কথায় জানা গেল, শুধু পড়াই নয়, তিনি নিজেও লিখতেন কবিতা। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের এই সাক্ষাৎতে তিনি কয়েক লাইন আবৃত্তি করলেন – শব্দচয়নে এমন নৈপুণ্য যে তা শুনে আমি স্তম্ভিত। রাস্তার ধারের এই মানুষটির কণ্ঠে কবিতার ছন্দ যেন জীবনের গভীর বোধকে স্পর্শ করছিল।
বিকেলের দিকে এক দোকানের সামনে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎই তিনি গুনগুন করে গাইতে শুরু করলেন একটি রবীন্দ্রসংগীত। সুরের পরিপক্কতা শুনে বোঝার উপায় নেই যে এটি একজন ভবঘুরের কণ্ঠস্বর। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি বুঝতে পারছিলাম না, এই সমস্ত প্রতিভা কি করে আমাদের চোখের সামনেই অদৃশ্য থেকে যায়। তিনি আবারও আমাকে চমকে দিলেন যখন হিন্দি, উর্দু এবং এমনকি কিছুটা ফারসি ভাষায় কথা বললেন।
সন্ধ্যা নামার আগে তিনি একটি পুরনো খাতা বের করলেন যেখানে জ্যামিতির জটিল সব সমস্যার সমাধান লিখে রেখেছিলেন। “এগুলো শখ,” বললেন তিনি লজ্জিত ভাবে। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর এই অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবিয়ে তুলল – কতজন শিক্ষিত মানুষই বা এইসব বিষয়ে তার ধারণার ধার-কাছ দিয়ে যেতে পারবেন? রাস্তার ধুলোমাখা জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই মেধাগুলো সমাজের কোন আঙ্গিনায় যাচাই করার সুযোগ পায় না।
দিনশেষে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম, তিনি একটি কাগজে কিছু লিখে দিলেন – একটি স্বরচিত কবিতা যার প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠেছিল রাস্তার জীবন এবং মানুষের বৈষম্যের গল্প। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে এই কবিতাটি যেন হয়ে উঠল সবচেয়ে মূল্যবান স্মারক। সমাজের প্রান্তে বসবাসকারী এই মানুষটির মধ্যে যে জ্ঞান ও সৃজনশীলতা লুকিয়ে আছে, তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামাজিক কাঠামোকে কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়।
শীতের রাত্রিঃ ফুটপাতে জীবন কাটানো
সন্ধ্যার ধূসর আলো যখন শহরের রাস্তাগুলোকে আস্তে আস্তে গ্রাস করতে শুরু করেছে, তখন তিনি আমাকে তার রাত্রিযাপনের স্থানটি দেখালেন – একটি বন্ধ ফুটপাতের দোকানের সামনের তিন ফুট চওড়া ফুটপাত। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর এই অভিজ্ঞতায় দেখলাম, কীভাবে তিনি সযত্নে তার সমস্ত জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখেন সেই সীমিত জায়গায়। একটি ছেঁড়া চাদর, পলিথিনের দুটি ব্যাগ আর প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তৈরি বালিশ – এই নিয়েই তার শয়ন ব্যবস্থা।
হঠাৎই এক ঝটকা ঠাণ্ডা হাওয়া আমাদের দিকে ধেয়ে এলো। তিনি তার পাতলা শালটি টেনে নিয়ে বললেন, “ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে তো রাত কাটানোই যায় না। হাত-পা জমে বরফ হয়ে যায়।” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে জানলাম, কীভাবে তারা শীতের রাতে বেঁচে থাকার কৌশল রপ্ত করেছে – কখনও রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে, কখনও হাসপাতালের বারান্দায়, আবার কখনও ধর্মশালার দরজায় আশ্রয় নেয় তারা।
তার কথায় ফুটে উঠল এক মর্মস্পর্শী বর্ণনা – “গত বছর পৌষ মাসে এক রাতে এত ঠাণ্ডা ছিল যে আমার সঙ্গী রামু সকালে আর উঠল না। ডাক্তার বললেন, হাইপোথার্মিয়া।” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের এই আলোচনায় আমি অনুভব করলাম, আমরা যারা উষ্ণ কম্বলের নিচে ঘুমাই, তারা কি কখনো ভেবেছি কনকনে শীতে ফুটপাথে শুয়ে থাকা মানুষের যন্ত্রণার কথা?
রাত যত গভীর হচ্ছিল, ততই তিনি তার অভিজ্ঞতার গল্প শোনাতে লাগলেন – কীভাবে বৃষ্টির রাতে পলিথিন দিয়ে শরীর মুড়ে রাখতে হয়, কীভাবে পত্রিকার পাতা শরীরে ভরে তাপ ধরে রাখার চেষ্টা করেন, আর কীভাবে কখনও কখনও দয়ালু মানুষদের দেওয়া পুরনো কোটই হয়ে ওঠে জীবন রক্ষাকারী বর্ম। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি দেখলাম, এই মানুষটির মুখে কোনো অভিযোগ নেই, আছে শুধু এক গভীর অভিযোজন ক্ষমতা।
বিদায় নেওয়ার সময় তিনি একটি অনুরোধ করলেন – “শীতকালে যদি কখনও কোনো ভবঘুরেকে পুরনো কম্বল দেন, তাহলে সেটা সরাসরি তার হাতে দিন। অনেক সময় দাতা সংস্থাগুলোর হাতে দিলে সেটা তাদের কাছে পৌঁছায় না।” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর শেষ প্রহরে এই সরল অনুরোধটি আমার হৃদয়ে গভীর দাগ কেটে গেল। শহরের আলোক-মালায় উদ্ভাসিত অট্টালিকাগুলোর নিচে যে অদৃশ্য মানুষেরা শীতে কাঁপে, তাদের জন্য আমাদের সামান্য সহানুভূতিই কি অনেক বড় কিছু হয়ে উঠতে পারে না?
মানবতার প্রশ্নঃ আমরা কতটা সহমর্মী
সন্ধ্যার শেষ আলোটি যখন মিলিয়ে যাচ্ছিল, আমার ভবঘুরে সঙ্গী তার ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর এই শেষ মুহূর্তে তিনি হঠাৎ বললেন, “আমার জন্য কষ্ট পাবেন না দাদা। শুধু রাস্তায় হাঁটার সময় একটু জায়গা দেবেন, বাসে পাশে বসতে দেবেন – এটাই যথেষ্ট।” এই সাধারণ আবেদনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গরিমাপূর্ণ মানবিকতা আমাকে স্তব্ধ করে দিল।
ফুটপাতের ধারে দাঁড়িয়ে আমি লক্ষ্য করলাম পথচারীদের দৃষ্টিভঙ্গি। কেউ তাকিয়ে দেখছে না, কেউ নাক সিঁটকিয়ে পার হচ্ছে, আবার কেউ তাড়াহুড়ো করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে এই দৃশ্যগুলো নতুন অর্থ পেল। আমরা কি কখনো ভেবে দেখি, প্রতিদিন যাদের সাথে একই বাতাসে শ্বাস নিই, তাদের অস্তিত্বকে এভাবে অস্বীকার করার অর্থ কী?
তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, “সবচেয়ে ব্যথা পাই যখন মানুষ আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে। মনে হয় আমি কোনো ভূত।” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের এই কথোপকথনে উঠে এলো এক মর্মান্তিক সত্য – আমাদের সমাজে ভবঘুরেরা শুধু বস্তি বা রাস্তার অংশ নয়, তারা মানবিক সম্পর্কের বৃত্ত থেকেও বাদ পড়ে যায়।
হঠাৎ তিনি একটি গল্প শোনালেন – একবার এক মহিলা তাকে খাবার দিতে গিয়ে প্লাস্টিকের প্লেটে রেখে দিয়েছিলেন, যেন স্পর্শও না করতে হয়। “খাবারটাই যদি দিলেন, সেই হাতটাও কি একটু এগিয়ে দেওয়া যেত না?” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, মানবতা কেবল দান করার মধ্যে নয়, সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার মধ্যেই তার প্রকৃত প্রকাশ।
বিদায়ের সময় তিনি বললেন, “আপনি আজ সারাদিন আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।” একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি বুঝলাম, আমাদের সমাজব্যবস্থায় এই মানুষগুলোর জন্য স্থায়ী সমাধান নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। শুধু ভিক্ষা বা ক্ষণিকের দয়া নয়, তাদের মানবিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই কি আমরা প্রকৃত মানবিকতা প্রমাণ করতে পারব না?
বাসায় ফেরার পথে আমার মনে হচ্ছিল, শহরের প্রতিটি উজ্জ্বল বিল্ডিংয়ের ছায়ায় যারা বাস করে, তাদের জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটানোর এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে, প্রতিটি মানুষেরই মর্যাদা আছে – তা সে যেই পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেন। আসল প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই মর্যাদাকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত?
ভবঘুরের সঙ্গে একদিনের শিক্ষা
একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন কাটিয়ে আমি শিখেছি, প্রতিটি মানুষেরই একটি গল্প আছে। ভবঘুরেরা সমাজের ছায়ার মানুষ নয়, তারা আমাদেরই প্রতিবিম্ব। তাদের জীবন সংগ্রাম আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজের অসমতা। এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে সহানুভূতি এবং সম্মানের গুরুত্ব। শেষ করবো আমার ভবঘুরে বন্ধুর একটি কথায় – “জীবন খুব ছোট, হৃদয়কে বড় করো।”
ফুটনোটঃ একজন ভবঘুরের সঙ্গে একদিন – শিরোনামের লেখাটি গত বছরের ডিসেম্বরে তীব্র শীতের মধ্যে লেখা। বিশেষ কিছু কারণে প্রকাশ করা হয়নি।