আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব, যদি তার আয় নির্দিষ্ট সীমার উপরে হয়। আগে করদাতাদেরকে সার্কেল অফিসে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে রিটার্ন জমা দিতে হতো, যা ছিল সময়সাপেক্ষ এবং অনেক সময় ভোগান্তির কারণ। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগের অংশ হিসেবে এখন ঘরে বসেই অনলাইনে বা ই-রিটার্নের মাধ্যমে কর রিটার্ন জমা দেওয়া সম্ভব।
২০২৫-২০২৬ করবর্ষের জন্য বাংলাদেশে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল, বা ই-রিটার্ন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এটি সরকারের ডিজিটাল কর প্রশাসন কর্মসূচির অংশ। এখন থেকে যে কোনো করদাতা দেশের যেকোনো স্থানে বসে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। ই-রিটার্ন ব্যবস্থার মাধ্যমে সময় বাঁচানো, প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং করদাতাদের ঝামেলা কমানো সম্ভব হবে।
সূচিপত্র
নতুন আয়কর আইন ২০২৩ এবং এর প্রভাব
আয়কর আইন ১৯৮৪ পরিবর্তন করে ২০২৩ সালে নতুন আয়কর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই নতুন আইন করদাতাদের জন্য প্রক্রিয়াটি সহজ ও আধুনিক করার পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে। নতুন আইনের কারণে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের সফটওয়্যার eReturn সিস্টেমও আপডেট করা হয়েছে। এর মাধ্যমে করদাতারা বাংলায় বা ইংরেজি উভয় ভাষাতেই ফরম পূরণ করে জমা দিতে পারবেন।
কেন অনলাইন আয়কর রিটার্ন বা ই-রিটার্ন জরুরি
আয়কর দাখিলের পুরো প্রক্রিয়াকে সহজ, দ্রুত ও স্বচ্ছ করতে অনলাইন ই-রিটার্ন এখন সর্বোত্তম সমাধান। এটি করদাতাকে কাগজপত্রের ঝামেলা ও অফিসে যাওয়া-আসার সময় অপচয় থেকে মুক্তি দেয়, সঙ্গে ত্রুটিমুক্ত রিটার্ন সাবমিশন নিশ্চিত করে।
- মূল সুবিধাসমূহঃ
- ঘরে বসে দাখিল- কম্পিউটার বা মোবাইল ব্রাউজার দিয়েই আয়কর রিটার্ন সাবমিট করা যায়।
- অফিসে লাইনের ঝামেলা নেই- ব্যাংক বা কর সার্কেল অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন কমে।
- স্বয়ংক্রিয় যাচাই- ডাটা সার্ভারে যাচাই হওয়ায় ভুল ধরা পড়ে দ্রুত।
- তাত্ক্ষণিক সতর্কবার্তা- তথ্য অসম্পূর্ণ/ভুল হলে সঙ্গে সঙ্গে নোটিফিকেশন আসে।
- ডিজিটাল রসিদ ও রেফারেন্স- সাবমিশনের সাথে সাথে Acknowledgement/Reference ID পাওয়া যায়।
- নিরাপদ পেমেন্ট- অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে কর পরিশোধ করা যায়।
- দুই ভাষায় ফরম- বাংলা ও ইংরেজি—যেটিতে স্বচ্ছন্দ সেটি বেছে নেওয়া যায়।
- সময় ও খরচ সাশ্রয়ঃ কাগজ, প্রিন্টিং, যাতায়াত, ফটোকপি—এসব খরচ কমে যায়। অনলাইন ড্যাশবোর্ডে বার্ষিক আয়ের তথ্য ও আগের বছরের আয়কর রিটার্ন কপি থাকায় পরের বছর ফাইল করা আরও দ্রুত হয়।
- ত্রুটিমুক্ত ও স্বচ্ছ হিসাবঃ
- আয়, কর রেয়াত এবং উৎসে কর (TDS) স্বয়ংক্রিয় ক্যালকুলেশনে কম ভুল হয়।
- ফরমের বাধ্যতামূলক ঘরগুলো ফাঁকা থাকলে সাবমিট করা যায় না—ফলে ভুল কমে।
- আপলোড বা এন্ট্রি করা ডকুমেন্টের ভিত্তিতে ডিজিটাল অডিট ট্রেইল তৈরি হয়—স্বচ্ছতা বাড়ে।
- কমপ্লায়েন্স ও জরিমানা-ঝুঁকি কমানোঃ নির্ধারিত সময়সীমার আগে সিস্টেম রিমাইন্ডার/নোটিফিকেশন দেয়। ফলে সময়মতো রিটার্ন দাখিল করা সহজ হয় এবং বিলম্বজনিত জরিমানার ঝুঁকি কমে। ত্রুটি থাকলে তাৎক্ষণিক ফ্ল্যাগ হওয়ায় সংশোধনের সুযোগ থাকে।
- ডাটা সিকিউরিটি ও গোপনীয়তাঃ ই-রিটার্নে লগইন/ওটিপি/পাসওয়ার্ড সুরক্ষা, এনক্রিপ্টেড ট্রান্সমিশন ও সার্ভার-সাইড ভ্যালিডেশনের
মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত থাকে। পাসওয়ার্ড শক্তিশালী রাখা ও OTP কারও সাথে শেয়ার না করা আবশ্যক।
ই-রিটার্ন করদাতাদের জন্য সময়সাশ্রয়ী, ত্রুটিনিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ সমাধান। বাড়তি খরচ ও ঝামেলা কমিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে আইনি কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে অনলাইনেই রিটার্ন দাখিল করা বুদ্ধিমানের কাজ।
কারা বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন দাখিল করবেন
নতুন আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও শ্রেণির করদাতাদের জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। কেবল করযোগ্য আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করলেই নয়, বরং সরকারি ও আর্থিক নানা সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রেও রিটার্ন দাখিল অপরিহার্য। আইন মেনে রিটার্ন দাখিল না করলে জরিমানা, অতিরিক্ত কর এবং আইনগত জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়।
- আয়ের ভিত্তিতে যাদের রিটার্ন বাধ্যতামূলকঃ
- পুরুষ- বার্ষিক আয়
৳৩,০০,০০০
টাকার বেশি হলে। - নারী- বার্ষিক আয়
৳৩,৫০,০০০
টাকার বেশি হলে। - ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে নাগরিক- বার্ষিক আয়
৳৩,৫০,০০০
টাকার বেশি হলে। - প্রতিবন্ধী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা- করমুক্ত সীমা
৳৪,৭৫,০০০
পর্যন্ত, এর বেশি হলে কর দিতে হবে এবং রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
- পুরুষ- বার্ষিক আয়
- পেশা ও ব্যবসার কারণে যাদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলকঃ
- টিন (TIN) সার্টিফিকেটধারী ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা।
- সরকারি/আধা-সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকুরিজীবী যাদের বেতনভাতা নির্দিষ্ট সীমার বেশি।
- ফার্ম বা কোম্পানির অংশীদার, পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার।
- ট্রেড লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী।
- নিবন্ধিত পেশাজীবী যেমন চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, হিসাববিদ ইত্যাদি।
- কোন সরকারি/বেসরকারি টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী।
- যানবাহন, বাড়ি বা অন্যান্য সম্পত্তির মালিক, যা বিলাসিতা বা উচ্চমূল্যের সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়।
- সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে যাদের রিটার্ন প্রয়োজনঃ বিভিন্ন আর্থিক ও প্রশাসনিক সেবা গ্রহণের জন্যও রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যেমনঃ
- ব্যাংক ঋণ গ্রহণ- বড় অঙ্কের ঋণ পেতে হলে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দেখাতে হয়।
- সঞ্চয়পত্র ক্রয়-
৳৫,০০,০০০
টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে রিটার্ন প্রমাণ বাধ্যতামূলক। - টেন্ডার অংশগ্রহণ- সরকারি ও বেসরকারি টেন্ডারে অংশ নিতে হলে রিটার্ন জমা দিতে হবে।
- ভূমি/ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন- উচ্চমূল্যের সম্পত্তি ক্রয়ে রিটার্ন দাখিল প্রমাণ আবশ্যক।
- লাইসেন্স/পারমিট গ্রহণ- ট্রেড লাইসেন্স, অস্ত্রের লাইসেন্সসহ অনেক অনুমতিপত্রে রিটার্ন প্রমাণ দরকার।
নতুন আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, কেবল আয় নয় বরং নানা পেশা, ব্যবসা ও সরকারি সেবা গ্রহণের কারণে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা এখন বাধ্যতামূলক। সময়মতো রিটার্ন না দিলে জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়। তাই করদাতাদের উচিত সময়মতো অনলাইনে বা অফলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়া।
ই-রিটার্ন নিবন্ধনের ধাপ
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হলে প্রথমেই করদাতাকে ই-রিটার্ন নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) ই-টিন সাইট secure.incometax.gov.bd এ ভিজিট করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সহজ, ব্যবহারবান্ধব এবং ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা যায়।
ধাপে ধাপে নিবন্ধন প্রক্রিয়া
- একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করুনঃ নতুন ব্যবহারকারীদের জন্য প্রথমে একটি একাউন্ট তৈরি করতে হবে। এখানে ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড সেট করতে হবে, যা ভবিষ্যতে লগইন করার জন্য প্রয়োজন হবে।
ছবিতে দেখানো, নিচের রেজিস্ট্রেশন ফর্মটি পূরণ করুন-
- মোবাইল নম্বর ভেরিফাই করুনঃ নিবন্ধনের সময় প্রদত্ত মোবাইল নম্বরে একটি সক্রিয়করণ কোড পাঠানো হবে। কোডটি প্রবেশ করালেই একাউন্টটি ভেরিফাই হয়ে যাবে।
- TIN আবেদন ফরম পূরণ করুনঃ ব্যক্তিগত তথ্য (নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্মতারিখ), আয়ের উৎস, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা ইত্যাদি সঠিকভাবে ফরমে পূরণ করতে হবে।
লগইন করার পর উপরের মত একটি পেইজ দেখবেন। এখানে বাম পাশের উপর থেকে, Tin Application অপশনে ক্লিক করুন।
এখানে করদাতার ধরণ (Taxpayer’s Status) বাছাই করবেন। যদি বাংলাদেশের নাগরিক হন, a) অপশনে Individual Bangladeshi সিলেক্ট করুন। অন্যান্য ক্ষেত্রে আপনার ধরণ অনুযায়ী একটি অপশন বাছাই করুন।
b) অপশনে, আপনার বয়স ১৮ এর উর্দ্ধে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলে, Having NID অপশন বাছাই করুন। যদি, বয়স ১৮ এর নিচে হয়, Minor/ Dependent অপশন বাছাই করুন।
এরপর আপনার আয়ের প্রধান উৎস নির্বাচন করতে হবে। চাকরিজীবিদের ক্ষেত্রে Service, পেশাজীবি যেমন ডাক্তার, প্রকৌশলী, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ইত্যাদি হলে Profession, ব্যবসা হলে Business নির্বাচন করুন।
এরপর আপনার চাকরী, পেশা বা ব্যবসার ধরণ বাছাই করুন। আমি এখানে আয়ের প্রধান উৎস Business (Individual/Firm) দিয়েছি। আমার ব্যবসার লোকেশন Chattogram সিলেক্ট করেছি।
Business Type বা Profession Type অপশনে যদি আপনার ব্যবসা বা পেশার ধরণ খুঁজে না পান, Business Location বাছাই করবেন। Location এর ক্ষেত্রে আপনার ব্যবসায়ের অবস্থান অনুসারে এলাকাটি বাছাই করুন।
তারপর নিচের Go to Next বাটনে ক্লিক করে পরে ধাপে যান।
ব্যক্তিগত তথ্য ও ঠিকানা
পরের পেইজে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ও ঠিকানা চাওয়া হবে। অবশ্যই তথ্যগুলো ইংরেজিতে পূরণ করবেন। (Must write in English)
আপনার নাম, লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর (১৭ ডিজিট) বা স্মার্ট কার্ড নম্বর (১০ ডিজিট) ও জন্মতারিখ যেন অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী হয়।
নিচের অংশে আপনার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা ইংরেজিতে লিখুন। ঠিকানা লিখার পর, Go to Next বাটনে ক্লিক করুন।
- সাবমিট করুন এবং সার্টিফিকেট সংগ্রহ করুনঃ সব তথ্য যাচাই করার পর সাবমিট করতে হবে। সফলভাবে সাবমিট হলে View Certificate অপশনে গিয়ে TIN সার্টিফিকেট ডাউনলোড করা যাবে (PDF ফরম্যাটে)।
hereby affirm that all information given above is correct and complete and I have not taken any TIN. এই লেখার পাশে টিক দিন এবং Submit Application বাটনে ক্লিক করুন।
আপনার টিন সার্টিফিকেট তৈরী হয়ে যাবে এবং আপনাকে এর সকল তথ্য দেখানো হবে। পরের পেইজ থেকে View Certificate ও তারপর Save Certificate বাটন ক্লিক করে e Tin Certificate PDF ফাইলটি ডাউনলোড করতে পারবেন।
- নিবন্ধনের ফলাফলঃ এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করদাতা একটি বৈধ ই-টিন সার্টিফিকেট পাবেন। ই-টিন সার্টিফিকেট ভবিষ্যতে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও, ব্যাংক একাউন্ট খোলা, ঋণ গ্রহণ, সঞ্চয়পত্র ক্রয়সহ নানা সরকারি ও আর্থিক কার্যক্রমেও ই-টিন সার্টিফিকেট প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া
ই-টিন নিবন্ধন সম্পন্ন করার পর অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা যায়। এর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) অনলাইন পোর্টালে লগইন করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সহজ, নিরাপদ এবং করদাতাদের জন্য সময়সাশ্রয়ী। নিচে ধাপে ধাপে রিটার্ন দাখিলের পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো। রেজিস্ট্রেশন শেষে লগইন করে TIN Application থেকে নতুন রিটার্ন ফাইল করতে হবে। ধাপগুলোঃ
ধাপে ধাপে রিটার্ন দাখিলের নিয়ম
- লগইন করুনঃ ই-টিন পোর্টালে আপনার ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে লগইন করুন। ড্যাশবোর্ড থেকে “File Return” অপশন নির্বাচন করুন।
এই ধাপে মোবাইল ভেরিফিকেশন করতে হবে। Verify বাটনে ক্লিক করার পর আপনার মোবাইলে একটি ৬ সংখ্যার OTP Code পাঠানো হবে।
এনবিআর ই রিটার্ন সিস্টেমে (e-Return System) ভিজিট করুন এবং ২ নং অপশন e Return এ ক্লিক করুন।
ডান পাশ থেকে, আপনার TIN নম্বর, পাসওয়ার্ড ও ক্যাপচা লিখে Sign in বাটনে ক্লিক করে সাইন ইন করুন।
সাইন ই করার পর নিচের মত একটি ড্যাশবোর্ড পাবেন। এখানে বাম পাশ থেকে Return Submission অপশনে ক্লিক করুন।
- আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ করুনঃ ফরমে আপনার আয়ের উৎস, বার্ষিক খরচ, করমুক্ত সুবিধা, বিনিয়োগ, সম্পদ ইত্যাদি সঠিকভাবে লিখতে হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আয়ের প্রমাণপত্রও যুক্ত করতে হবে।
ই রিটার্ন ফরমের শুরুতে আপনাকে Tax Assessment Information বা আয়কর নির্ধারণ সংক্রান্ত তথ্য অর্থাৎ আয়ের সন ও উৎস সংক্রান্ত তথ্য দিতে হবে।
এ ধাপে আপনি যে যে উৎস থেকে আয় করেছেন তার তথ্য দিতে হবে। নিচের ছবিতে খেয়াল করুন।
আয়ের উৎস অনুযায়ী তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করবেন। মনে রাখবেন এখানে বাৎসরিক আয় পূরণ করতে হবে।
যাদের আয় অন্যান্য উৎস দিয়েছেন, তার অন্যান্য উৎসের ক্যাটাগরিতে পাওয়া না গেলে List থেকে Any Other Income সিলেক্ট করবেন। নিচের ছবিতে দেখানো হয়েছে।
Tax Exempted Income – কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত আয়/ করমুক্ত আয়
ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, সফটওয়ার ও আইটি ব্যবসা এবং এ ধরনের বিভিন্ন উৎস থেকে আয় সম্পূর্ণ করমুক্ত। তাই এসব খাত থেকে আয় থাকলে তা এখানে সিলেক্ট করতে হবে। করমুক্ত আয় (Tax Exempted Income) এর অপশনটি নিচের ছবিতে দেখানো হলো।
ধাপে ব্যয়ের তথ্য দিতে হবে। যদি আপনার মোট সম্পদ ৪০ লক্ষ টাকা বা তার বেশি হয়, অবশ্যই ব্যয়ের তথ্য বিবরণী আকারে পূরণ করতে হবে। এজন্য IT10B ফরম টি অবশ্যই পূরণ করতে হবে। ফরমটি পূরণের জন্য Yes দিন।
যদি আপনার মোট সম্পদ ৪০ লক্ষ টাকার কম হয়ে থাকে, আপনাকে এটি পূরণ না করলেও চলবে। এক্ষেত্রে আপনার বাৎসরিক পারিবারিক ও ব্যক্তিগত খরচসমূহের মোট পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে।
যদি আপনি নতুন করদাতা হয়ে থাকেন, সম্পদের ঘরে আপনার সকল সম্পদের তথ্য ও ধরণ অনুযায়ী লিখুন। সঞ্চয়পত্র কত টাকা, অন্য কোন ডিপিএস, নগদ ও ব্যাংক জমা, ফার্ণিচার ও ইলেক্ট্রনিকস, স্বর্ণালংকার সব তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করুন। কোন তথ্য না লুকালেই ভাল। নিচের ছবিতে দেখুন।
- তথ্য যাচাই করুনঃ জমা দেওয়ার আগে সমস্ত তথ্য ভালোভাবে যাচাই করুন। ভুল তথ্য জমা পড়লে ভবিষ্যতে জটিলতার মুখোমুখি হতে পারেন।
অফলাইন রিটার্ন (Offline Return)
বামপাশের Yellow কালারের বাটন-Proceed to offline (Paper) Return ক্লিক করে আয়কর রিটার্ন ফরমটির প্রিন্ট কপি নিন। তারপর ফরমটি আপনার সংশ্লিষ্ঠ আয়কর সার্কেল অফিসে জমা দিন। এরজন্য কোন ফি পরিশোধ করতে হবেনা। Proceed to Online Return ক্লিক করে অনলাইনে রিটার্ন সাবমিট করতে পারবেন।
অনলাইন রিটার্ন (Online Return)
ডানপাশের Blue কালারের বাটন- Proceed to Online Return ক্লিক করে অনলাইনে রিটার্ন সাবমিট করতে পারবেন।
উপরের ছবির মত রিটার্ন ফরমের একটি প্রিভিউ দেখতে পারবেন। ফরমের একদম নিচে আপনার সম্মতি প্রদানের জন্য Verification and Signature অপশনে Yes দিতে হবে।
- সাবমিট করুনঃ যাচাই শেষে রিটার্ন সাবমিট করুন। সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার তথ্য NBR সার্ভারে সংরক্ষণ করবে।
- রসিদ সংগ্রহ করুনঃ রিটার্ন সফলভাবে সাবমিট হলে অনলাইনে একটি রসিদ (Acknowledgement Receipt) জেনারেট হবে। এটি ডাউনলোড করে সংরক্ষণ করুন, কারণ ভবিষ্যতে প্রমাণ হিসেবে এটি প্রয়োজন হতে পারে।
- ভুল সংশোধনের সুযোগঃ অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের অন্যতম সুবিধা হলো ভুল তথ্য দেওয়া হলে করদাতা সেটি সংশোধন করতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ভুল সংশোধন করে নতুন করে রিটার্ন জমা দেওয়া যায়। এ কারণে অনেক করদাতা এখন অনলাইন রিটার্নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা এখন অত্যন্ত সহজ এবং ব্যবহারবান্ধব। লগইন থেকে শুরু করে ফরম পূরণ, সাবমিশন ও রসিদ সংগ্রহ পর্যন্ত সবকিছুই ঘরে বসে করা যায়। এটি করদাতাদের জন্য সময়, খরচ এবং ঝামেলা কমিয়ে এনেছে।
রিটার্ন জমা দেওয়ার সময়সীমা
আয়কর রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়সীমা মানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, ২০২৫-২০২৬ করবর্ষের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের শেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ নভেম্বর, ২০২৫। নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন জমা না দিলে করদাতাকে অতিরিক্ত জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়।
- সময়ের গুরুত্বঃ সময়মতো আয়কর রিটার্ন জমা দিলে করদাতার জন্য বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন,
- জরিমানার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া।
- কর পরিশোধের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
- ব্যাংক ঋণ, টেন্ডার বা বিভিন্ন সরকারি সুবিধা গ্রহণে সমস্যা হয় না।
- ভবিষ্যতে অডিট বা তদন্তের সময় সমস্যায় পড়তে হয় না।
- সময়সীমা বাড়ানোর সুযোগঃ অনেক সময় করদাতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে না পারলে উপকর কমিশনারের কাছে আবেদন করে সময়সীমা বাড়ানোর সুযোগ পেতে পারেন। তবে অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত এটি নিশ্চিত নয় এবং বিলম্বজনিত জরিমানা আরোপ হতে পারে।
২০২৫-২০২৬ করবর্ষে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ সময় ৩০ নভেম্বর, ২০২৫। করদাতাদের উচিত নির্ধারিত সময়ের আগেই অনলাইনে বা অফলাইনে রিটার্ন দাখিল করা। এতে শুধু জরিমানার ঝুঁকি কমবে না, বরং আইনগত নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
রিটার্ন দাখিল না করলে জরিমানা
আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন দাখিল না করলে বা আয় সংক্রান্ত প্রমাণপত্র জমা দিতে ব্যর্থ হলে করদাতাকে বিভিন্ন ধরনের
জরিমানা দিতে হয়। নিচে জরিমানার তালিকা টেবিল আকারে দেওয়া হলোঃ
ক্ষেত্র | জরিমানা |
---|---|
রিটার্ন দাখিল না করলে | সর্বশেষ ধার্যকৃত করের ১০% বা ন্যূনতম ৳১,০০০ |
রিটার্ন অব্যাহত না রাখলে | প্রতি ১ দিনের জন্য ৳৫০ |
উৎসে করের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলে | সর্বশেষ ধার্যকৃত করের ১০% বা ৳৫,০০০ , যেটি বেশি |
কর পরিশোধের সার্টিফিকেট প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে | ৳৫,০০০ পর্যন্ত, অব্যাহত ব্যর্থতায় প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৳১,০০০ |
- রিটার্ন জমা না দিলে জরিমানাঃ রিটার্ন জমা না দিলে করদাতাকে বাধ্যতামূলকভাবে ন্যূনতম কর দিতে হয়। এলাকাভেদে ন্যূনতম করের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্নঃ
- ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-
৳৫,০০০
- অন্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায়-
৳৪,০০০
- অন্য সকল এলাকায়-
৳৩,০০০
- ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-
- অতিরিক্ত জরিমানার বিধানঃ শুধু ন্যূনতম কর পরিশোধ নয়, বরং সময়মতো রিটার্ন জমা না দিলে অতিরিক্ত জরিমানাও আরোপ করা হতে পারে।
যেমন, বিলম্বের কারণে প্রতিদিন জরিমানা বৃদ্ধি, কিংবা ধারাবাহিক ব্যর্থতার ক্ষেত্রে করদাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ।
সঠিক সময়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে করদাতাকে জরিমানা, ন্যূনতম কর এবং অতিরিক্ত বিলম্ব ফি প্রদান করতে হয়। তাই জরিমানা ও জটিলতা এড়াতে নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন জমা দেওয়াই সর্বোত্তম সমাধান।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
প্রশ্ন- টিন থাকলেই কি কর দিতে হবে?
উত্তর- না, টিন থাকলেই কর দিতে হবে না। শুধুমাত্র করযোগ্য আয় থাকলে কর হিসাব অনুযায়ী পরিশোধ করতে হয়।
প্রশ্ন- আমার আয় নেই, টিন থাকলেও রিটার্ন দাখিল করতে হবে কি?
উত্তর- ২০২২-২০২৩ অর্থবছর থেকে টিন থাকলেই রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক নয়। তবে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যেমন সরকারি সুবিধা গ্রহণ, সঞ্চয়পত্র ক্রয়, বা ব্যাংক ঋণ গ্রহণের জন্য রিটার্ন দাখিল প্রয়োজন হতে পারে।
প্রশ্ন- রিটার্ন দাখিলের শেষ সময় কখন?
উত্তর- ২০২৫-২০২৬ করবর্ষের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর, ২০২৫। সময়মতো জমা না দিলে জরিমানা বা অতিরিক্ত ফি ধার্য হতে পারে।
শেষ কথা
আয়কর রিটার্ন দাখিল একটি নাগরিক দায়িত্ব। অনলাইনে ই-রিটার্ন ব্যবস্থা চালুর ফলে এটি এখন অনেক সহজ হয়েছে। তবে, সঠিকভাবে তথ্য প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। ভুল তথ্য দিলে ভবিষ্যতে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তাই করদাতাদের উচিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আগে থেকে প্রস্তুত রাখা এবং প্রয়োজনে অভিজ্ঞ কারো সহায়তা নেওয়া। এভাবে বাংলাদেশে কর ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও আধুনিক করা সম্ভব।
২০২৫-২০২৬ করবর্ষের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সুবিধা করদাতাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ই-রিটার্নের বা আয়কর রিটার্নের মাধ্যমে ঝামেলা কমবে, সময় বাঁচবে এবং প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে। যেকোনো করদাতা, যাদের আয়কর দাখিল বাধ্যতামূলক, তারা অনলাইনে সহজেই তাদের রিটার্ন